কাজী নূর
‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,/ ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ঐ লোক।/ জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে।’ নিজের জন্মতিথিকে স্মরে এমনই বর্ণনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। জন্মের ১৬৪ বছর পেরিযে গেলেও তিনি বাঙালির জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছেন, তাকে স্মরণ করতে হয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ যেন অবিচ্ছেদ্য এক মহাকাব্য। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির কাছে আনন্দঘন উৎসবের দিন।
আজ পঁচিশে বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপাল ১৮৬১ সালের ৭ মে (বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরদা সুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুুরুষেরা বাংলাদেশের খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।
শৈশব থেকেই ঠাকুর পরিবারের উচ্চতর সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়ের বহু জ্ঞানী, গুণী, খ্যাতিমান মানুষের সাহচর্য লাভ করেন তিনি। হয়ে ওঠেন আপামর বাঙালির রবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী, গল্পকার। তিনি প্রধানত কবি। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। বাঙালি সমাজে তার রচিত সংগীতের জনপ্রিয়তা এত বছর পরেও তুলনাহীনভাবে বাড়ছে। তিনি ২ হাজার গান রচনা করেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে রয়েছে। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা।
জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মৃত্যুর পর বিশ্বভারতী থেকে ৩৬ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া ১৯ খণ্ডের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র’। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’। এই বইয়ের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্র প্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়।
লেখালেখির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে এবং উড়িষ্যায় জমিদারীগুলো তদারকি শুরু করেন কবি। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১২৯০ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ (৯ ডিসেম্বর, ১৮৮৩) খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহির বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী ভবতারিণী দেবীর নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী দেবী।
রবীন্দ্রনাথের মাঝে বহুমাত্রিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলেও তিনি নিজেকে ‘কবি’ হিসেবে পরিচয় দিতে চেয়েছেন। শেয বয়সে বলেছিলেন, তার ‘একটি মাত্র পরিচয় আছে, তিনি ‘ কবিমাত্র’। কিন্তু মহাকালের প্রবহমান ধারায় তিনি শুধু কবিমাত্র নন, তিনি আজ ‘কবিগুরু’ বিশ্বকবি’। বাঙালির মনন ও সৃজনে এক অনন্য নাম রবীন্দ্রনাথ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর ব্যথিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘রবিহারা’ কবিতায় লিখেছিলেন-‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারের কোলে/ বাংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি/ তুমি চলে যাবে বলে/ শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে।’