বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরের পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে যশোর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজপথে হতে থাকে পৃথক পৃথক বিক্ষোভ মিছিল। শুধু মিছিল স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকেনি রাজপথ; জুলাইয়ের কন্ঠস্বরের মৃত্যুতে হয়েছে গায়েবানা জানাজা, মসজিদে মসজিদে দোয়া। কর্মসূচি থেকে দাবি ওঠে, হাদি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ভারত থেকে এনে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার। জুলাইয়ের কন্ঠস্বরের এ হত্যাকাণ্ডে বিচার না হলে দেশে নতুন করে হাদী তৈরি হবে না বলেও জানান নেতৃবৃন্দ।
গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তির দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর অবস্থায় হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
নিউজের ভিডিও দেখতে লিংকে ক্লিক করুন .. ..
সেখানে একটি অপারেশন শেষে তাকে নেয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। পরবর্তী সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। পরে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর খবরের পর পরেই তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন .. .. এমএম কলেজে ওসমান হাদীর স্মরণে মোমবাতি প্রাজ্বলন ও মৌন মিছিল
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে যশোর-চৌগাছা সড়কে অবস্থান নেন। বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এ সময় শিক্ষার্থীরা- “দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা”, “হাদি ভাই কবরে, খুনি কেন ভারতে?”, “যে ভারত খুনি পালে, সেই ভারত ভেঙে দাও”, “ভারতীয় আধিপত্য ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”, “ছাত্রলীগের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”, “ইনকিলাব ইনকিলাব-জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ”, “আপোস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম” এবং “মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ”-এমন বিভিন্ন স্লোগান দেন। প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ করে পরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয় কর্মসূচি।

এদিকে হাদিকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে যশোরে বিক্ষোভ করেছে ছাত্র জনতা। শুক্রবার জুম্মা নামাজ শেষে শহরের রেলগেটস্থ মডেল মসজিদের সামনে থেকে মিছিলটি বের হয়। এতে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্র জনতা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক রাজনীতিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। বিক্ষোভ মিছিলে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
স্লোগানগুলোতে ছিল- ‘আমি কে তুমি কে, হাদি হাদি’, ‘আমার সোনার বাংলায় খুনি লীগের ঠাঁই নাই’, ‘ফ্যাসিবাদের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’ এবং ‘আমরা সবাই হাদি হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো’। মিছিলটি শহরের মুজিব সড়ক, দড়াটানা হয়ে পুরাতন কসবা এলাকায় শহীদ মিনারে যেয়ে শেষ হয়। সেখানে শরীফ ওসমান হাদির আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া করেন নেতৃবৃন্দ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যশোরের প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ‘হাদি ভাইয়ের মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠ হারিয়েছি। একজন দেশপ্রেমিককে হারিয়েছি।
হাদির মতো দেশপ্রেমিককে হত্যা করায় যশোরবাসী ফুঁসে উঠেছে। আগামীতে যাতে কোন রাজনৈতিক নেতা বা জুলাই যোদ্ধাকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে না হয়; তার জন্য সরকারকে এক্ষুণিই ভূমিকা নিতে হবে। একই সাথে যে সন্ত্রাসী আমাদের দেশের সম্পদকে, জুলাই যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তাকে ভারত থেকে অনতিলম্বে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) সাকিব শাহরিয়ার বলেন, হাদির হত্যার পিছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে; নতুন করে বলার দরকার নেই। যারা হত্যা করেছে, ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ তাদের মাধ্যমে উল্লাসিত রূপ দেখতে পেয়েছি। তারা রীতিমতো উল্লাস করছে। একজন সত্যিকারের মানুষকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে জুলাই যোদ্ধাদের কন্ঠ রোধ করতে চেয়েছে ; সেটা কখনোই সম্ভব হবে না।
এদেশে যদি হাদি হত্যার বিচার না হয়, এই মৃত্যুর বিচার না হয়, তাহলে কেউ সাহস করে আর হাদি হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবে না।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের নেত্রী আশা লতা বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে যারা অংশ নিয়েছিলাম, তারা সকলেই হাদির অনুসারি। আমরা কেউ মৃত্যুকে ভয় পাইনা। আমরা সবসময় জুলাই আন্দোলনে মৃত্যুর জন্য মুখিয়ে ছিলাম। আগামীতেও থাকবো। কিন্তু কোন সহিংসতা আমাদের কাম্য নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে নিরাপত্তা গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে।’
অন্যদিকে হাদির মৃত্যুতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর যবিপ্রবির কেন্দ্রীয় মাঠে এ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় যবিপ্রবি বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা ছাড়াও উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মজিদ অংশ নেন। এ সময় যবিপ্রবি উপাচার্য বলেন, ওসমান হাদির সাহস ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যে অকুতোভয়তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তার চিন্তা, ভাবনা ও চেতনা ধারণ করে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে আমরা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করব।
আমাদের এই ছোট ভূখণ্ডকে একটি অপশক্তি বারবার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে এবং সেখান থেকে আমাদের ফিরে আসাকে আবারও সেই অপশক্তিটা ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। আমি আবারও বলছি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। এই ঘটনায় আজ শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) সকল ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে অফিসসমূহ খোলা থাকবে। শুক্রবার বিকেল ৪ টায় সকল ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের সমন্বয়ে জরুরি ভিত্তিতে এক অনলাইন মিটিংয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে যশোর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরাও। এদিন বিকেলে শহরের মণিহার চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে আরএন রোড হয়ে দড়াটানা এসে শেষ হয়। জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মোস্তফা আমীর ফয়সল ও সদস্য সচিব রাজিদুর রহমান সাগরের নেতৃত্বে এই মিছিল বের হয়। এসময় তারা হাদি হত্যার বিচারের দাবি জানান।
এছাড়া হাদির স্মরণে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে মোমবাতি প্রাজ্বলন ও মৌন মিছিল করেছে শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় এমএম কলেজ ছাত্রদলের উদ্যোগে কলেজ ক্যাম্পাসে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচির শুরুতে কলেজ ক্যাম্পাসের ‘চেতনায় চিরঞ্জীব’ ভাস্কর্যের পাদদেশে মোমবাতি প্রাজ্বলনের মাধ্যমে ওসমান হাদির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এ সময় মোমবাতি হাতে নিয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কয়েক মিনিট নিরবতা পালন করেন। পরে সেখান থেকে একটি মৌন মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কলেজ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ‘চেতনায় চিরঞ্জীব’ ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়।

