♦ ‘টেণ্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস ও শ্রমিক নেতা রবিন অধিকারী ব্যাচা ও বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু’
♦ ‘ হিন্দুুদের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা তুলে নিজ নামে কেনেন ৪২ শতক জমি
♦‘ভয়ে এলাকা ছাড়া এখনো অনেক হিন্দু পরিবারের সদস্য’
প্রতীক চৌধুরী
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের তিনবারে সাবেক সংসদ সদস্য রণজিৎ কুমার রায় আওয়ামী লীগের শাসন আমলে অবৈধভাবে কামিয়েছেন শ’ শ’ কোটি টাকা। এমপি হওয়ার আগে আধা পাকা টিনের ঘরে বসবাস করলেও ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অসংখ্য গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক বনে গেছেন তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য, টেণ্ডার বাণিজ্য, সরকারি বরাদ্দ লুট, জমি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও আলোচিত ছিলেন তিনি। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব উল্লেখ করছেন, সেই হিসাব অনুযায়ী ১৫ বছরে রণিজত রায়ের ১৩৩ গুণ ও স্ত্রী নিয়তি রায়ের ২৬৩ গুণ সম্পদ বেড়েছে। বাস্তবে রণজিৎ কুমার রায় ও তার স্বজনদের সম্পদ বেড়েছে হাজার গুণ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনে পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনি। এ বিষয়ে সাবেক এমপি রণজিৎ কুমার রায়ের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য, দখলদারিত্ব ছিল অবৈধ সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার :
সাবেক এমপি রণজিত কুমার রায়ের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য। রণজিত কুমার রায়, স্ত্রী নিয়তি রাণী ও দুই ছেলে রাজীব রায় ও সজীব রায় অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়োগ বাণিজ্য নিরঙ্কুশ করার জন্যই তারা সভাপতি হতেন বলেও অভিযোগ আছে। টানা ১৫ বছর সংসদ সদস্য থাকায় একচেটিয়া নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন রণজিত কুমার রায়।
২২ লাখ টাকার বিনিময়ে বাঘারপাড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে হাবুল্যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ৩২ লাখ টাকার বিনিময়ে রায়পুর কলেজের অধ্যক্ষ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ধলগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে আগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাতিয়ানতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে খাজুরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরসার শিক্ষক নিয়োগ, ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে অভয়নগরের বিসিসি মুজহিদা মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ করেছেন।
শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার প্রত্যেকটি স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে মোটা অংকের ঘুষ দিতে হত রণজিৎ কুমার রায়কে। এছাড়াও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী, স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্যে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। দুই উপজেলায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত ও কলেজ সরকারিকরণের নামে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন রণজিৎ রায়। অবৈধ টাকা আয়ের আরেকটি উৎস ছিল টেণ্ডার বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কমিশন গ্রহণ। রণজিৎ রায়ের পক্ষে টেণ্ডার ও প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য তদারকি করতেন নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র সুশান্ত কুমার দাস ও শ্রমিক নেতা রবিন অধিকারী ব্যাচা ও বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু।
রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি জোরপূর্বক ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের অভিযোগ রয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক হাসান আলীকে (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দেয়ার কথা বলে ৫ বিঘা জমি তার অনুসারীর নামে লিখে নেন তৎকালীন এমপি রণজিত কুমার রায়। নির্বাচনে পরাজিত হন হাসান আলী। এরপর চাপে পড়ে সেই জমি হাসান আলীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন রণজিৎ রায়।
বন্দবিলা ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, খাজুরা শশ্মানের জমি কেনার কথা বলে হিন্দুুদের কাছ এক কোটি টাকা চাঁদা তুলে ৪২ শতক জমি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন রণজিৎ রায়। বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামের সুশীল মল্লিক মাস্টারের ১২ বিঘা (৪৬ শতকে বিঘা) জমি জোরপূর্বক লিখে নিয়েছেন রণজিৎ রায়। ভুক্তভোগী সুশীল মাস্টারের স্ত্রী অনিমা মল্লিক ভয়ে এখনো এলাকাছাড়া রয়েছেন। এছাড়াও ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে সরকারি ও খাস জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে রণজিতের বিরুদ্ধে।
নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় :
নবম, দশম ও একাদশ সংসদে যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন রণজিৎ কুমার রায়। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় রণজিত রায়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল সর্বসাকূল্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। এর মধ্যে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এক লাখ টাকা মূল্যের ৪ বিঘা জমি, খাজুরায় ৪ শতক জমির উপর ৫০ হাজার টাকা মূল্যের টিনের ঘর। বার্ষিক আয় এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী নিয়তি রানীর নগদ ৭০ হাজার টাকা, ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। আয়ের কোন উৎস ছিল না।
১৫ বছরের ব্যবধানে রণজিত-নিয়তি রানী দম্পতির সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় রণজিত কুমার রায়ের ৪ কোটি ৫০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ টাকা দামের ১২ বিঘা কৃষিজমি, ঢাকার পূর্বাচলে ৩০ লাখ টাকা দামের রাজউকের প্লট, ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের দালান এবং ১০ লাখ টাকার অকৃষি জমি। বর্তমানে রণজিত রায়ের নিজের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্থায়ী আমানত হিসেবে বিনিয়োগ (ডিপিএস) ১২ লাখ ৫১ হাজার টাকা, ২৩ লাখ টাকার জিপ গাড়ি, এক লাখ টাকার ৬০ তোলা সোনা, এক লাখ ৩০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রি ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাব।
২০২৪ সালের হলফনামায় রণজিৎ রায়ের স্ত্রী নিয়তি রানীর স্থাবর সম্পদ আছে এক কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার তিনটি বাড়ি ও ৫০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট, যা ২০০৮ সালে ছিল না। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রণজিতের স্ত্রী নিয়তি রানীর নামে নগদ টাকা আছে ৫১ লাখ ১৫ হাজার। ২০০৮ সালে যা ছিল ৭০ হাজার। স্থায়ী আমানত হিসেবে (ডিপিএস) বিনিয়োগ আছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আরও আছে ৫৫ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া আছে ৪৫ হাজার টাকা দামের ১০ তোলা সোনা, ৪০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রি ও ১৫ হাজার টাকার আসবাব।
হলফনামায় দেয়া সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন করেছেন রণজিৎ কুমার রায়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তার সম্পদের চিত্র। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এমপি রণজিৎ কুমার রায়ের যশোর শহরের রেল রোডে একটি পাঁচতলা ও একটি তিনতলা রাড়ি রয়েছে। যশোরের লোহাপট্টিতে একটি বাড়ি, যশোর নিউ মার্কেটে দুটি ফ্ল্যাট, বাঘারপাড়ায় একটি দুইতলা বাড়ি, বাঘারপাড়ার খাজুরায় একটি চারতলা বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে দারুস সালাম রোড়ে দুইটি ফ্ল্যাট, দুই ছেলের নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ও সল্টলেকে দুটি বাড়ি আছে। যশোরের চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায় ২২৫ একর জমি, খুলনার ফুলতলা উপজেলায় ৫০ একর জমির উপর মাছের ঘের কিনেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গোপন প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এক কোটি টাকা দামের একটি পাজেরো, দুই ছেলের ৬০ লাখ টাকার প্রাইভেটকার, স্ত্রীর ত্রিশ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেটকার ও ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০টি ট্রাক (কাভার্ডভ্যান) রয়েছে। এছাড়াও আরও কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন রণজিৎ রায় ও তার পরিবারের সদস্যরা।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে জেস টাওয়ার শাখার জনতা ব্যাংকের একটি লকারে রক্ষিত ২শ’ ভরি স্বর্ণের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন রণজিৎ রায়। ওই সময় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের মালিকানা নিয়ে তোলপাড় হয়। ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়।