প্রতীক চৌধুরী
প্রয়াণের দেড়শ’ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। জন্মের দুইশো’ বছর পরও অনবদ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যদিয়ে অমর হয়ে আছেন। তাঁর জন্মস্থান যশোরের সাগরদাঁড়ি এখন তীর্থভূমি। মহাকবির ২০২তম জন্মদিন উপলক্ষে কবিতীর্থ সাগরদাঁড়িতে এখন লাখো প্রাণের ঢল নামে। এবছর ২৪ জানুয়ারি শুরু হওয়া স্মরণানুষ্ঠান ও সপ্তাহব্যাপি মেলা ঘিরে ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে সাগরদাঁড়ির মধুপল্লী। প্রতিদিন দেশবরণ্যে কবি, সাহিত্যিকদের আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলার বাহারি আয়োজনে জমজমাট কবির জন্মস্থান। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের উপস্থিতিতে অন্যরকম উন্মাদনা চলছে। মহাকবির সৃষ্টিকর্ম ও তার দেশপ্রেমের নজির নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার প্রয়াস বাস্তবায়ন করছে জেলা প্রশাসন।
শতবছর পেরিয়ে মধুসূদন স্মরণোৎসব:
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় মারা যান মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এরপর কবির ভাইয়ের মেয়ে কবি মানকুমারি বসু ১৮৯০ সালে সাগরদাঁড়িতে কবির প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন। সেই থেকে সাগরদাঁড়িতে মধুসূদনের জন্মদিন উপলক্ষে স্মরণোৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে। আর ১৯৮০ দশকে স্মরণোৎসব ঘিরে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী মেলা আয়োজন হচ্ছে।
মধুসূদন গবেষক ও কবি খসরু পারভেজ বলেন, ১৯১৯ সালে কলকাতার বিশিষ্ট কবি নগেন্দ্রনাথ সোম ‘মধুস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন মাইকেল মধুসূদনের জন্মতিথিতে স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সেই হিসাবে স্মরণ অনুষ্ঠানের বয়স কমপক্ষে ১০৬ বছর। ধারণ করা হয় তাঁরও আগে থেকে মধুসূদন স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে সাগরদাঁড়িতে মেলা চালু হয়েছে ১৯৮০ দশকের দিকে বিসিক’র উদ্যোগে। দিনে দিনে স্মরণোৎসব ও মেলার পরিসর বেড়েছে। এ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মানুষের মাঝে মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে। মানুষ তাকে জানতে পারছে।’
এদিকে, এবছর ২৪ জানুয়ারি সাত দিনব্যাপি স্মরণোৎসব ও মেলা শুরু হয়েছে। স্মরণ ও মেলা ঘিরে কপোতাক্ষ পাড়ের সাগরদাঁড়ি গ্রামে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছে। মহাকবির পূণ্যভূমি সাগরদাঁড়িতে লাখো প্রাণের উচ্ছ্বাস। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলা ও স্মরণোৎসবে যোগ দিচ্ছেন মানুষ। মহাকবির বাড়ি সংরক্ষণ করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বাড়ি ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। স্মৃতিচিহ্নি ও নানা স্মরণিকা থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে জানার সুযোগ পাচ্ছেন নতুন প্রজন্মও।
সাতক্ষীরা থেকে আসা দর্শনার্থী কাজমির হোসেন বলেন, পরিবার নিয়ে কবির বাড়ি ঘুরতে এসেছি। তাঁর নানা স্মৃতি ও স্মারক দেখছি। তাঁর কবিতা বইয়ে পড়েছি। এখানে এসে আরও বিস্তারিত জানতে পারছি। সাথে মেলার আয়োজন রয়েছে। সবমিলিয়ে খুবই ভাল লাগছে।’
আরেক দর্শনার্থী কেশবপুরের জাকির হোসেন বলেন, আধুনিক কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর স্মরণে জন্মভূমিতে একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। মধুপল্লীরও উন্নয়ন হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত।’
মহাকবির বাড়ির মালি রবিউল ইসলাম বলেন, ১৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করি। সারা বছরই দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। শীতের মৌসুমে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাগম হয় মহাকবির জন্ম উৎসবের অনুষ্ঠান ঘিরে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছে।
সাগরদাঁড়ি গ্রামের বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে সাগরদাঁড়ি মিউজিয়ামে কাজ করছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে জানানোর জন্যই এই মিউজিয়াম চালু আছে। মধুসূদনের লেখা বই, স্মরণিকা, চিত্রকর্মের মাধ্যমে তাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরছি। বিশেষ করে যারা মধুসূদনকে নিয়ে গবেষণা করেন, তাদেরকে আমরা সহযোগিতা করছি।’
ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলায় মানুষের ঢল:
চার দশকের বেশি সময় ধরে সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম উৎসব ঘিরে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা বসছে। নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, মোটরসাইকেল ও কার রেসের মত আয়োজনে ঘিরে মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। সেই সাথে মেলার অন্যতম অনুষঙ্গ হরেক রকমের মিষ্টি, প্রসাধীন, খেলনা, নিত্যপণ্যের পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা পছন্দের পণ্য ক্রয় করছেন। উপভোগ করছেন বিনোদন।
খেলনার স্টলের মালিক ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার রাশেদ শেখ বলেন, ২০ বছর ধরে মেলায় দোকান দিচ্ছি। এবারও এসেছি। মেলার জায়গা বরাদ্দ পেতে বেশি টাকা গুণতে হবে। বেচাকেনা শুরু হয়েছে ভাল। আশা করছি আরও ভাল হবে। আরেক দোকান মালিক শরিফ মোল্লা বলেন, মেলায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর বেশি লোক সমাগম হচ্ছে।’ মেলার প্রসাধণী ও খেলনার স্টল মালিক মো. বাপ্পারাজ বলেন, জিনিসপত্রের পাশাপাশি জায়গা ভাড়াও বেড়েছে। মেলায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। আশা করি বেচাকেনাও বাড়বে।
রাকিবুল ইসলাম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, পরিবারের লোকজন নিয়ে মেলায় এসেছি। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন রাইডে চড়েছি। খুবই মজা করলাম। এখন কেনাকাটা করছি।’
ইমরান হাসান নামে দর্শনার্থী বলেন, আমার মনে হয়েছে মেলার অন্যতম আকর্ষণ কৃষিপ্রযুক্তি প্রদর্শন মেলা। আমাদের শেকড় তো কৃষি। এ স্টলে দর্শনার্থীরা ফসলের উন্নত বীজ ও চাষ প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন। এটা ভাল উদ্যোগ।
দর্শনার্থীদের হৃদয়স্পর্শ করেছে ‘জুলাই বিপ্লব কর্ণার’:
জুলাই বিপ্লবের গৌরবময় চিত্র তুলে ধরে একটি কর্ণার করা হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে জুলাই বিপ্লবের বীর শহিদদের গৌরবাগাঁথা। সংগ্রামের দিনগুলির আলোকচিত্র। স্মরণ করা হয়েছে বিপ্লবের শহিদ আবু সাঈদসহ নিহত ও আহতদের। জুলাই বিপ্লবে নিহত যশোরের কেশবপুরের ভালুকঘরের ছেলে তৌহিদুর রহমানের ছবি ও সংক্ষিপ্ত সংগ্রামের ইতিহাস স্থান পেয়েছে এই কর্ণারে। ৫ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর গৌরবগাঁথা। আন্দোলনে কেশবপুর ও যশোরের স্থিরচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে ঢাকায় আন্দোলনের সেইসব দিনগুলি ফুঁটে উঠেছে আলোকচিত্রে। জুলাই বিপ্লব কর্ণারে এসে দর্শনার্থীরা যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকে গভীরচিত্তে স্মরণ করছেন।
বাগেরহাটের রামপাল থেকে আসা আবদুল মাজেদ বলেন, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদেরকে এখানে স্মরণ করা হয়েছে। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ।
তন্বী খাতুন নামে এক নারী বলেন, সন্তানদের নিয়ে মেলায় এসেছি। কর্ণারের সামনে দিয়ে যাওযার সময় বুকের ভিতর কেঁদে উঠেছে। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে দেখছি কর্ণার। আর ভাবছি, যারা সন্তান হারিয়েছেন তারা আর কখনো ফিরে পাবেন না। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নতুন বাংলাদেশ। তাদেরকে এভাবেই স্মরণ করা উচিত।
মেলার সার্বিক আয়োজন বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সপ্তাহব্যাপি মেলা চলছে। এখন পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বাকি দিনগুলোও ভালভাবে শেষ হবে বলে আশাবাদী।