বাংলার ভোর প্রতিবেদক
মাগুরা শহরের শ্রীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে উত্তরের সড়কে তিন কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। মাঠের বুক চিরে ধুলা বালির মেঠোপথ। এই পথ মাড়িয়ে চলতেই দেখা মিললো বড় একটি পুকুর। পুকুর পাড়েই টিনের ছাউনি আর ইটের দেয়ালের পাকা বাড়ি। দেখে বোঝা যাচ্ছে এখনো প্লাস্টারের কাজটি বাকী। সপ্তাহ খানিক আগেও নিজনান্দুয়ালী মাঠপাড়াতে এই বাড়িটি কার জিজ্ঞাসা করতেই স্থানীয়রা বলতেন হিটু শেখের বাড়ি। আর এখন শিশু থেকে যুবক, আবাল বৃদ্ধ বনিতা এক নামেই ডাকছেন ‘ধর্ষক হিটু শেখের বাড়ি’।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজমিস্ত্রী হিটু শেখের এমন করুণ পরিণতি হওয়ার কারণ হিসাবে স্থানীয়রা বলছেন, তার গর্হিত অপরাধেরই ফল। গত বুধবার (৫ মার্চ) রাতে নিজ পুত্রবধূর আট বছর বয়সী বোনকে ধর্ষণ করেন হিটু শেখ। শুধু ধর্ষণ নয়; ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যাচেষ্টাও চালান তিনি। সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে পাহাড়সম অভিমান নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ওপারে পাড়ি জমায় শিশুটি।
ধর্ষক হিটু শেখের বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো সারাসারি তিনটি রুমেই তালাবদ্ধ। প্রতিবেশীরা জানালেন, বাড়ির চার জনকে গ্রেফতার করার পর এ বাড়ি এখন ফাঁকা। শুধু হিটু শেখের বৃদ্ধা মা বাড়িতে থাকছেন। তবে এদিন বৃদ্ধাকেও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। গরুর গোয়াল ঘরের এক কোণে একটা খাটে রাত্রীযাপন করেন রোকেয়া বেগম (৭৫)। ঘটনার দিন বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশীরা বাড়ির দরজায় চক দিয়ে লিখে দিয়েছে ধর্ষণকারী হিটু শেখের বাড়ি। পুলিশ ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেলো, হিটু শেখের স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। মেয়েকে বিয়ে দেয়াতে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। বড় ছেলেকে বিয়ে না দিলেও ছোট ছেলে রাতুলকে চার মাস আগে বিয়ে দেন। বিয়ের পর ছেলের বউকে মাঝে মধ্যে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন হিটু। বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম দিকে ঝগড়া করে বাবার বাড়িতে যায় ভুক্তভোগী শিশুটির বড়বোন। বাবার বাড়িতে যেয়ে শ্বশুরের অপকর্মের কথা জানিয়ে আর শ্বশুর বাড়িতে যাবেন না বলে জানান। এরপর পরিবার ও স্বামীর অনুরোধে ৪ মার্চ ছোট বোনকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসেন। এরপর গত বুধবার রাতে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তার স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এরপর সকাল ছয়টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তার বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়। এই ঘটনায় শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজীব শেখের ভাই রাতুল শেখ (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগমকে (৪০) রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
নাম না প্রকাশ করে কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, ‘ঘটনার রাতে কোন চিৎকার বা হট্টগোল হয়নি। বেলা ১০টার দিকে শিশুটি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে; তখন শিশুটির বোন কান্নাকাটি করতে থাকে। কান্নাকাটি শুনেই তারা হিটুর বাড়িতে যান। যেয়ে দেখেন শিশুটির বোনের শ্বাশুড়ি জাবেদা বেগম শিশুটিকে তেল মালিশ করছে। এরপর একটি ভ্যান ডেকে পাশ্ববর্তী হুজুরের কাছে নিয়ে যান। জ্বিনের আছর লেগেছে এমন কথা বলে ঝাঁড়ফুক দিয়ে দিতে বলেন। শিশুটির শারীরিক অবস্থা দেখে দ্রুত তাদের হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন ওই হুজুর। এরপর তারা বেলা ১১ টা ৫০ দিকে মাগুরা জেনারেল হাসপাতাল ভর্তি করে। সেখানেও শিশুটির বোনের শ্বাশুড়ি তথ্য গোপন করে চিকিৎসকের বলেন শিশুটির খিচুনিতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কথামতোই জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শিশু ওয়ার্ডে রেফার্ড করেন। সেখানে চিকিৎসক ও অন্যরা বিষয়টি টের পেলে শাশুড়ি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। পরে শিশুটির বোন হাসপাতালে যান। স্থানীয়রা জানান, ‘শিশুটিকে নির্যাতনের পরে দ্রুত হাসপাতালে নিলেও শিশুটির জীবনপ্রাণ এমন সন্ধিক্ষণে পড়তো না।’
মাগুরা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সুভাস চন্দ্র হালদার বলেন, ‘শিশুটিকে নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য গোপন করা হয়। শিশুটির বোনের শাশুড়ি আমাদের জানান খিচুনি রোগে আক্রান্ত। সেই অনুযায়ী তাকে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করি। সেখানে তার গলায় আঘাত ও যৌনপথে ক্ষত দেখে শিশুটির বোনের শ্বাশুড়িকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই; এরপর কিছু না বলে পালিয়ে যায় সে। পরে শিশুটির বোন আসে; এরপর পুলিশকে জানায় ও উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর হাসপাতালে রেফার্ড করে।’
হিটুদের পরেই বাড়ি ওলিয়ার রহমানে বাড়ি। ওলিয়ারের স্ত্রী রেশমাসহ কয়েকজন জানান, ‘রাতে ঘটনাটি ঘটলেও জানাজানি হয় দুপুরে হাসপাতালে নেয়ার পর। হিটুর ছেলের বউরে জ্বীনে ধরেছে এমন অপবাদ দিয়েছে। মাঠের ভিতরে বাড়ি, একা একা থাকতে হতো বলেই তার ছোট বোনকে নিয়ে আসে। হিটু এর আগেও থেকেই এরকম অপকর্মে জড়িত। নজরুল নামে আরেক প্রতিবেশি জানান, ‘হিটু নামকরা রাজমিস্ত্রী। কারোও সাথে তেমন মেশে না। ঝগড়া করে না। কোন নেশাও করে না। তবে পাড়াপ্রতিবেশি গৃহবধূদের সাথে শ্লীলতাহানি করার তার পুরনো স্বভাব। হিটু শেখ এ ধরনের কাজ করেছে কিন্তু তার পরিবার এসব বিষয় ধামাচাপা দিয়ে এসেছে। তবে হিটুর দুই ছেলের সম্পর্কে স্থানীয়রা কোন খারাপ অপবাদের কথা বলতে পারেনি।
হিটু শেখের পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন শিশুটি। আট বছর বয়সী শিশুকে কিভাবে ধর্ষণ করলো, কক্ষে বোন ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে ঘুমালে দরজা খুললো কে? ধর্ষণের সঙ্গে আর কেউ কি জড়িত, সবার মনে এখন কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
ধর্ষকদের আইনি সহায়তা না দিতে বারের নোটিশ:
শিশুটির আইনি সহায়তায় জন্য মাগুরা বিএনপির পক্ষ থেকে একটি আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় মাগুরা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান টগরের নেতৃত্বে প্যানেল গঠন করা হয়েছে। একই সাথে শিশুটির ধর্ষকদের পক্ষে কোন আইনজীবীদের আইনি সহায়তা না দিতে আইনজীবীদের নোটিশ পাঠিয়েছে মাগুরা আইনজীবী সমিতি। সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহেদ হাসান টগর বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। ভুক্তভোগী শিশু ও তার ভগ্নিপতির বাড়ি পরিদর্শন করেছি। আমরা সকল অ্যাডভোকেটকে নোটিশ পাঠিয়েছি এই মামলায় বিবাদীর পক্ষের কেউ যাতে লড়াই না করে।’