বাংলার ভোর প্রতিবেদক
জীবন যুদ্ধে হার না মানা সাতক্ষীরার মেয়ে সাজেদা বেগম। বর্তমানে আত্মপ্রত্যয়ী এ নারী ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত যশোরের গদখালি-পানিসারা এলাকার এক সফল ফুলচাষী। সাতক্ষীরা পৌর এলাকার পারকুখরালী সরদার পাড়ার যার জন্ম ১৯৮৪ সালে। সাত ভাই-বোনদের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান সাজেদা বেগম। তার বাবা আতিয়ার সরদার ও মা আকিমন বেগম।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করা সাজেদা বেগমের ১৫ বছর বয়সেই বিয়ে হয় যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি ইমামুল হোসেনের সঙ্গে। মোটামুটি ভালই চলছিল তাদের সংসার। বিয়ের প্রায় আট বছর পর ২০০৪ সালে বাড়ির সামনের শিশুগাছ থেকে পড়ে ইমামুল হোসেনের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আকস্মিক এ দুর্ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অসুস্থতায় অবর্ণনীয় অভাব-অনটন নেমে আসে। তখনই সংসারের হাল ধরেন সাজেদা বেগম। স্বামীর অনুপ্রেরণা আর স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাড়ির পাশেই বর্গা নেওয়া ১০ কাঠা জমিতে শুরু করেন জারবেরা ফুলের চাষ। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতাও পান তিনি। এখন ফুলেল জীবন সাজেদার।
সাজেদার ঘরে এখন আর কোনো অভাব নেই। ফুল চাষের টাকা দিয়ে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই সাড়ে চার শতক জমির ওপরে একতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন সাজেদা। ১০ কাঠা জমির জারবেরা ফুল চাষ বেড়ে এখন সাড়ে চার বিঘায় (৩৩ শতকে এক বিঘা) দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষামূলক লিলিয়াম ফুলেরও চাষ করছেন তিন শতক জমিতে। দুই ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। মাঠে জমি কেনার জন্য টাকা গচ্ছিত রেখেছেন। ভালো জমি পেলেই কিনবেন বলে মনস্থির করেছেন।
সাজেদা বেগম জানান, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে হয় তার। স্বামী ইমামুল হোসেন ফুলের চাষ করতেন। ২০০৪ সালে গাছ থেকে পড়ে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। অনেক জায়গায় চিকিৎসা করানো হয়েছে। কিন্তু তার পা ভালো হয়নি। সেই সময়ে তিনি নিজেই ফুল চাষ শুরু করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজের খেতে শ্রম দেওয়া শুরু করেন। সেই শ্রমের মূল্যও পেয়েছেন। ফুল চাষের প্রশিক্ষণ নিতে সরকারিভাবে কয়েকবার ভারতেও গিয়েছেন। এখন বছরে কয়েক লাখ টাকা ফুল চাষ থেকে আয় হয়।
সাজেদা জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও মেয়েকে অন্তত বিএ (সম্মান) পাস করানোর পর বিয়ে দেবেন। তানিয়া এখন ঝিকরগাছা উপজেলার সরকারি কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষে লেখাপড়া করছেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ফুল পাঠানো, ইন্টারনেটে যোগাযোগ ও টাকা লেনদেনে তানিয়া তাকে সহায়তা করেন। ছেলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।
তিন বছর আগে হাড়িয়া গ্রামের ফুলের মাঠে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে বিনা মূল্যে ৩৩ শতকের এক বিঘা জমিতে নিয়ন্ত্রিত আধুনিক সেচব্যবস্থা, সংবলিত (ড্রিপ ইরিগ্রেশন) স্টিল পাইপের একটি শেড দেয়া হয় সাজেদাকে। ওই শেড তাকে স্বাবলম্বী হতে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। শেডের পাশে আগে থেকেই এক বিঘা জমির আরেকটি শেড ছিল সাজেদার। এখন পাশের মাঠে আরও একটি জারবেরা ফুলের শেড নির্মাণ করেছেন। এখন মোট তিনটি জারবেরা ফুলের শেড রয়েছে তার। জারবেরাগাছ রোপণের তিন মাস পর থেকে ফুল বিক্রির উপযোগী হয়।
সাজেদা বলেন, এক বিঘা জমিতে জারবেরা ফুলের বাগানসহ একটি শেড নির্মাণ করতে এখন ১২ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। তবে রোপণের তিন মাস পর থেকে ফুল বিক্রির উপযোগী হয়।
গড়ে পাঁচ টাকায় প্রতিটা জারবেরা ফুল সারা বছর বিক্রি হয়। তবে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুলের দাম বেশি পাওয়া যায়। এ মৌসুম ঘিরে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের বিশেষ ব্যস্ততা থাকে। ফুলের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ সময়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এই দুই মাসে জমজমাট ফুলের ব্যবসা হয়।
বেশি ফুল পাওয়ার লক্ষ্যে জারবেরার খেতে বিশেষ পরিচর্যা করছেন সাজেদা। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে তিন হাজার টাকা খরচ করে জৈব ও রাসায়নিক সার এবং সেচ দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে গরম কম থাকলে বেশি ও ভালো মানের ফুল পাওয়া যাবে। ঠান্ডা, গরমের ওপরে অনেকটা নির্ভর করছে।
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘২০১৮ সালে ঝিকরগাছা উপজেলার সাজেদা বেগমসহ সাতজন আদর্শ ফুলচাষিকে উৎসাহিত করতে বিএডিসি থেকে এক বিঘা জমিতে জারবেরা ফুলের সাতটি শেড নির্মাণ করে দেওয়া হয়। ওই শেডের সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ-সুবিধাসহ নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থা রয়েছে, যা গদখালির ফুলখেতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সাজেদা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও উদ্যমী। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে এগিয়ে দিতে ফুল সমিতির একটি ভূমিকা রয়েছে।’