বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরে আদ্-দ্বীন ফাউণ্ডেশন আয়োজিত তাফসীরুল কোরআন মাহফিলে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে অসংখ্যা মানুষের মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার, ঘড়ি, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিস খোয়া গেছে। এসব ঘটনায় শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত কোতয়ালি থানায় পাঁচ শতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগ দাখিল হয়েছে। এছাড়া মাহফিলে গিয়ে পদদলিত ও মানুষের ধাক্কাকাক্কিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২১ জন। এর আগে শুক্রবার রাতে শহরতলী পুলেরহাটস্থ আদ-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশ এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, যশোর শহরতলী পুলেরহাটস্থ আদ্-দ্বীন ফাউণ্ডেশন আয়োজিত তিন দিনব্যাপি তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের শেষ দিন ছিলো শুক্রবার। এদিন রাতে বক্তব্য রাখেন আন্তজার্তিক খ্যাতিমান বক্তা মিজানুর রহমান আজাহারী। তার আসার খবরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল নামে সমগ্র মাহফিল এলাকা। সকালে থেকেই শীত উপেক্ষা করে মানুষ জমায়েত হয়। বিকেল থেকে মাহফিল স্থান ছাপিয়ে সড়ক, মহাসড়কেও শিশু, নারী, পুরুষের ঢল নামে। দুপুরের পর সড়কে যানজট দেখা দেয়। এজন্য অনেকেই পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছায়। সব সড়কের ঢেউ গিয়ে মিশে পুলেরহাটে।
মাহফিল প্রাঙ্গনে পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। এদিন সন্ধ্যায় আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহও বক্তব্য রাখেন। মাহফিল শেষে মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে কোতয়ালী মডেল থানায় ভুক্তভোগীরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে রীতিমতো লাইন ধরেন। শনিবার রাত আটটা পর্যন্ত মাহফিলে মোবাইল, স্বর্ণলংকার ও অন্যান্য জিনিস খোয়া যাওয়ার ঘটনায় পাঁচ শতাধিক জিডি হয়েছে।
প্রতিনিয়ত যেভাবে জিডি করতে ভুক্তভোগীরা থানায় আসছেন যাতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কোতয়ালী মডেল থানার ডিউটি অফিসার শারমিন আক্তার বলেন, ‘শুক্রবার রাত থেকে অসংখ্যা মানুষ মোবাইল হারিয়ে যাওয়া বা চুরির ঘটনায় জিডি করতে আসে। তাৎক্ষণিক যারা মোবাইলের ডকুমেন্ট দেখাতে পেরেছে তারা জিডি করতে পেরেছে। শনিবার সকাল থেকে রীতিমতো ভিড় লেগেছে। রাত ৮টা পর্যন্ত ৫ শতাধিক জিডি হয়েছে। জিডির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।’
যশোরের দৈনিক স্পন্দনের নিজস্ব প্রতিবেদক মুর্শিদুল আজীম হিরু বাংলার ভোরকে জানান, ‘মেয়েকে নিয়ে আজহারী সাহেবের মাহফিল শুনতে গেছিলাম। লোকজনের ভিড়ে ঠেলাঠেলিতে মোবাইল হারিয়ে যায়। মোবাইলের সন্ধান পেতে থানায় জিডিও করেছি।’
মায়ের দেড় ওজনের একটি গলার হার খোয়া যাওয়ার পর শনিবার দুপুরে জিডি করতে এসেছেন সদরের রুপদিয়া থেকে ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বাংলার ভোরকে বলেন, ‘আমরা মা মহিলা প্যান্ডেলে বসে আজহারী হুজুরের ওয়াজ শুনছিলেন। একপর্যায়ে গলায় হাত দিয়ে দেখেন তার গলায় হার নেই। তাই থানায় জিডি করতে এসেছি। বউয়ের গলার চেইন হারিয়ে যাওয়ার পর থানায় জিডি করতে আসেন শহরতলী নওয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা হয়রত হোসেন। তিনি বাংলার ভোরকে বলেন, ‘এভাবে ওয়াজ মাহফিলে চুরি হওয়ার ঘটনা দুঃখজনক এবং অপরাধমূলক কাজ। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমগম হয়েছে গতকাল। চোররাও এধরণের অনুষ্ঠানে সুযোগটা কাজে লাগায়। কর্তৃপক্ষের আরও সর্তক ও ব্যবস্থাপনা ভালো করা উচিত ছিলো। আর আমাদেরও সচেতন হওয়া উচিত ছিলো, ব্যাপক সমগম স্থানে দামি দামি জিনিসপত্র পরিধান ও নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।’
শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক বাংলার ভোরকে বলেন, ‘যশোরের ইতিহাসে এমন বড় মাহফিল হয়নি। ওয়াজ মাহফিলে গেছিলাম ইমান আমল ঠিক করতে। আর চোরেরা তাদের ব্যবসা খুঁজে নিলো। হাজার হাজার মানুষের মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার খবর শুনেছি মাহফিলের মাঠেই। অনেকেই দুরদুরান্ত থেকে এসেছে, তাই জিডি করতে কাগজপত্র দেখাতে না পারায় জিডি করতে পারছে না। যারা চুরির মতো এ ধরণের কাজ করছে মাহফিলে; তারা মাহফিলের সৌন্দর্য্য নষ্ট করেছে। তাদের বিচার হওয়া উচিত।’
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বাংলার ভোরকে বলেন, ‘তিন দিনব্যাপি বৃহৎ মাহফিল হয়েছে যশোরে। পাঁচ থেকে সাত লক্ষ মানুষ সমাগম হয়েছে। এর ভিতরে অসংখ্যা মানুষের মোবাইল, স্বর্ণলংকারসহ মুল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। অনেকেই জিডি করছেন। কয়েকটি চুরির অভিযোগও পেয়েছি। পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এদিকে, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার পর মাহফিল শেষ হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পদদলিত হয়ে একাধিক ব্যক্তি মারা যাওয়ার খবর। আহতের সংখ্যাও অর্ধশতাধিক। তবে হাসপাতাল ও থানা সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেনারেল হাসপাতালে পদদলিত হয়ে ২১ জন ভর্তি হওয়ার খবর জানা গেছে। এর মধ্যে রাতেই ১০জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আর ১১জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোতয়ালি থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক বাংলার ভোরকে বলেন, ‘মাহফিলে আহত বা মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। মাহফিলে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। ফলে মৃত্যু নিয়ে গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।’
পহেলা জানুয়ারি বুধবার থেকে তিনদিন ব্যাপী এই মাহফিল শুরু হয়। মাহফিলের প্রথম দিন বুধবার আলোচনা করেন আল্লামা মামুনুল হক ও আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিন আলোচনা করেন মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ও মুফতি আমির হাজমা। শেষ দিন শুক্রবার আলোচনা করেন শায়খ আহমাদুল্লাহ ও ড. মিজানুর রহমান আজহারী।