বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের টানা তিন দিন বৃষ্টিতে ১০ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমির ধান ও সবজি ক্ষতির আশংকা করছে কৃষি বিভাগ। এছাড়াও ভেসে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের, পুকুর, বিল ও বাওড়। ভারি বর্ষণে কৃষি ও মৎস্যখাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পথে বসার উপক্রম চাষী ও কৃষকরা। কৃষি ও মৎস্য বিভাগ, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে প্রকৃত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করছে। কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৪১১ হেক্টর। সেখানে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৪৫ হেক্টর। কিন্তু এ বছর টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে ১০ হাজার ১৫০ হেক্টর আমন ধান। এদিকে, আগাম শীতকালীন সবজি ৭ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ৪৪৫ হেক্টর সবজি ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে। এখনো অনেক জায়গায় ফুলকপি এবং বাঁধাকপির জমিতে হাঁটু পানি। পানি-বাতাসের চাপে লাউ এবং পটলের মাচা মাটিতে পড়ে গেছে। মুলা, পালং শাক, লাল শাক, ওলকপির জমিতেও পানি জমে আছে। ফুলকপি এবং বাঁধাকপির চারার উপরেও পানি উঠে গেছে।
সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের বীরনারায়ণপুর এলাকার কৃষক শওকত আলী জানান, ফুলকপি লাগানোর দুইদিন পরেই বৃষ্টি। এক বিঘা জমির ফুলকপি নষ্ট হয়ে গেল। এখন চিন্তায় আছি নতুন করে আবার কি চাষ করব। দুঃখের বিষয় হলো ১০ কাঠা জমির ফুলকপির উপর হাঁটু পানি উঠে গেছে। এ জমির ফসল ধরেই নষ্ট হয়ে গেল। মাঠ ধরে কৃষকের স্বপ্ন সবই শেষ হয়ে গেছে। আসলে কয়েক বছরের মধ্যে এমন বৃষ্টি দেখা যায়নি। এ বছর প্রচুর বৃষ্টি। ধানের উপরে পানি থৈ থৈ করছে।
একই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, দেড় বিঘা পাতা কপি লাগানো হয়েছে। টানা ৩ দিন বৃষ্টিতে গাছ সব মাটির নিচেই পুতে গেছে। এ কপি গাছ বাঁচলেও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে পচে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে, চারা নতুন করে তৈরি করাও সম্ভব না। কৃষকের এ বছর বিপদের পর বিপদ।
লেবুতলা ইউনিয়নের বীরনারায়নপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি আর বাতাস একসাথে হয়ে এক বিঘা লাউয়ের মাচা মাটিতে পড়ে গেছে। প্রতিদিন প্রায় ২ থেকে আড়াইশ’ লাউ হত। কিন্তু এই বৃষ্টিতে সবই শেষ হয়ে গেল। মাঠে আবার নতুন করে সবজি তৈরি করতে প্রায় ২ মাস সময় লাগবে। এ বছর যে বৃষ্টি হল তা কয়েক বছরে দেখা যায়নি।
কৃষক ইমন আলী জানান, বৃষ্টির চাপে ১০ কাঠা ফুলকপির ক্ষেতে পানি উঠে গেছে। এ বছর ১০ কাটা পালং শাক ছিল তাও নষ্ট হয়েছে। সব জায়গায় দুর্ভাগ্য। মাঠের ধান প্রায় সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ধান হলেও তেমন বেশি ভালো হবে না। আর সবজি কি করে হবে। এখন নতুন করে ফুলকপি এবং পাতাকপির চারা তৈরি করে লাগানো সম্ভব না।
যশোর সদরের লেবুতলা গ্রামের তরিকুল ইসলাম জানান, দেড় বিঘা ফুলকপি পানির নিচে ডুবে গেছে। আমার জীবনে একটানা এত বৃষ্টি দেখিনি। সবজি পানিই সহ্য করতে পারে না। সেখানে সবজির ক্ষেতেই হাঁটু পানি। এদিকে পানি না টানলে ধানও হবে না। কারণ মাঠে ধানের উপর পানি থৈ থৈ করছে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, যশোরে ১০ হাজার ১’শ ৫০ হেক্টর জমির ধান প্লাবিত হয়েছে। আর ৪শ’ ৪৫ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। এদিকে যে ধান প্লাবিত হয়েছে এখানেও পানি কমতে শুরু করলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়া শুরু করছে। বৃষ্টির আশঙ্কাও কমে গেছে। আশা করি দু-একদিনের মধ্যে সবজি এবং ধানের পানি নিষ্কাশন হয়ে যাবে।
২৫ কোটি টাকার রেণু পোনার ক্ষতি:
যশোরে গত তিন দিনের ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম মৎস্য পোনা উৎপাদন ও বিপণন কেন্দ্র যশোর শহরতলীর চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর প্রায় অর্ধশতাধিক পুকুর। এ সকল পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা মজুদ বা সংরক্ষণ করা ছিল। জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বর্ষণের কারণে হ্যাচারি মালিকরা প্রায় ২৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে।
যশোর চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর এক হ্যাচারি মালিক শাহীন হেসেন বলেন, আমার তিনটি পুকুরে কয়েক প্রজাতির পোনা মাছ মজুদ করা ছিল। গত রোববার পর্যন্ত হওয়া বৃষ্টিতে পুকুর তলিয়ে পোনা মাছ সব ভেসে গেছে। আমার এ পুকুরে প্রায় দুই লাখ টাকার পোনা মাছ মজুদ করা ছিল।
আরেক হ্যাচারি মালিক আমিন বলেন, বৃষ্টির কারণে পুকুরে পানির পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে আটকানোর সময় পাইনি। এ ছাড়া পানির তাপমাত্রার একটি বিষয় আছে যার কারণে অনেক পোনা মাছের পুকুর তো তলিয়ে ভেসেই গেছে, তা বাদেও অনেক পোনা মাছ মারা গেছে। সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লোকসানের মুখে পড়ে গেলাম।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, দুই দিনের বৃষ্টিতে চাঁচড়া মৎস্য পল্লীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা মজুদ করা প্রায় ৯০ শতাংশ হ্যাচারি-পুকুর পানিতে তলিয়ে ভেসে গেছে। চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর প্রায় অর্ধশতাধিক হ্যাচারি মালিকেরা এ ভারী বৃষ্টিপাতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।