♦ শ্মশানের ৭৭ শতাংশ জমি রণজিতের নামে রেজিস্ট্রি
♦ সুশীল মাস্টারের ৪ একর জমি লিখে নিয়ে টাকা দেয়নি
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনে তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন রণজিৎ কুমার রায়। তার নির্বাচনী এলাকায় ১৫ বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। হিন্দুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে কিংবা জিম্মি জমিজমা লিখে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি হিন্দুদের শ্মশানের জমিও। সাধারণ হিন্দুদের চাঁদার টাকা কেনা শ্মশানের জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। তার দাপটে জিম্মি ছিল দলের ত্যাগী ও সাধারণ নেতাকর্মীরা।
টাকার বিনিময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চাকরি দিয়েছেন। তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম উৎস ছিল নিয়োগ বাণিজ্য। দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন রণজিত কুমার রায়ের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর স্বপরিবারে আত্মগোপনে চলে গেছেন রণজিত কুমার রায়। এজন্য এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, যশোর বাঘারপাড়া উপজেলার ধান্যকুড়া মৌজায় অবস্থিত খাজুরা কেন্দ্রীয় শ্মশান। এখানে খাজুরা এলাকার সাত গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সৎকার করা হয়। নিজস্ব জমি না থাকায় চিত্রা নদের পাড়েই সরকারি জমিতেই শ্মশানে কাজ করা হত। নদ খনন করার সময় শ্মশান বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। এলাকার মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে শ্মশান সংলগ্ন ৭৭ শতক জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩৫ নং ধান্যপুড়া মৌজায় ১৪৩ দাগের সাত শতক ও ১৩৭ দাগের ২৪ শতক মোট ৩১ শতক জমি ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্ব আল আমীন মন্ডলের ছয় ওয়ারিশ রণজিত রায়ের নামে জমি লিখে দেন।
যার দলিল নং ৩৭৪৮। দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা। একই মৌজার ১৩৬ নং দাগের ৪৬ শতক জমি ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর কাজী রবিউল ইসলাম ও তার মা’সহ বাকি সাত ভাই বোন রণজিত কুমার রায়ের নামে লিখে দিয়েছেন। যার দলিল নং ৪৩৬৭। দুইটি দলিলে মোট মূল্য দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৪৪ হাজার। অথচ এই জমি কেনার কথা বলে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধান্যকূড়া মৌজার চিত্রা নদের ধারে শ্মশানের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। কোন রকমে ইটের মেঝেতে চিতা তৈরি করা হয়েছে। উপরে ছাউনি কিংবা কোন দেয়াল নেই। পাশে কেনা জমিতেও সবজি চাষ হচ্ছে। এই জমি বর্গা নেয়া জাকির হোসেন বলেন, জমির আগের মালিকের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। এখন এমপির লোকের কাছ থেকে বাৎসরিক ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে বর্গা চাষ করছেন।
ধান্যখোলা গ্রামের পুরোহিত জয়দেব ব্যানার্জি বলেন, শ্মশানের জন্য সাত গ্রামের হিন্দুদের চাঁদার টাকায় ৭৭ শতক জমি কেনা হয়েছে। কিন্তু সেই জমি শ্মশানের নামে রেজিস্ট্রি হয়নি। এমপি রণজিত কুমার রায়ের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে ওই সময় প্রতিবাদ করলেও আমলে নেয়া হয়নি।
একই এলাকার তেলিধান্য গ্রামের বাসিন্দা গোবিন্দ বিশ্বাস বলেন, সাধারণ মানুষের চাঁদার টাকায় কেনা শ্মশানের জমি এমপির নামে রেজিস্ট্রি হয়েছে। এটা শুনে সবাই ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। আমরা চাই শ্মশানের জমি শ্মশানের নামেই ফিরে আসুক।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, রেজিস্ট্রির সময় বলা হয় জমি শ্মশানের নামে রেজিস্ট্রি করলে ডিসির নামে চলে যাবে। নিজেদের কেনা জমি সরকারের নামে দেয়া যাবে না। এমপি রণজিতের নামে রেজিস্ট্রি করলে ভাল হবে। সেই হিসেবে তার নামে রেজিস্ট্রি করা হয়।
শুধু খাজুরা কেন্দ্রীয় শ্মশানের জমি নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বী স্কুল শিক্ষক সুশীল কুমার মল্লিকের প্রায় ৪ একর জমি লিখে নিয়েছেন সাবেক এমপি রণজিত কুমার রায়। বাঘারপাড়া উপজেলার চাপাতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সুশীল কুমার মল্লিকের বাড়িতে এক মুসলিম পরিবার বসবাস করছেন। ভিটে জমি তারা কিনেছেন। একই মৌজার প্রায় ৪ একর বাগান ও ফসলি জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। কিন্তু সুশীল মাস্টারকে জমির টাকা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বছর দুই আগে তিনি মারা যান। তার স্ত্রীকেও প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন পলাতক রয়েছেন।
সুশীল মল্লিকের ভাতিজা শ্যামল মল্লিক জানান, তার কাকা হাইস্কুলের শিক্ষক ও কাকিমা স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরি করতেন। দুই সন্তানে আগেই ভারতে চলে গেছেন। কাকা একসঙ্গে ৪ একর জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এলাকায় একসঙ্গে এত জমি কেনার লোক ছিল না। সাবেক এমপি রণজিত রায় ওই জমি কিনে নেন। টাকা পয়সা দিয়েছে কিনা জানি না।’
এ বিষয়ে বন্দবিলা ইউপি চেয়ারম্যান সবদুল হোসেন খান বলেন, সাবেক এমপি রণজিত কুমার রায় জোরপূর্বক সুশীল মাস্টারের জমি লিখে নেন। তাকে জমির টাকা দেননি। সুশীল মাস্টারের স্ত্রীকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করেছেন। কাকিমা আমার পরিষদে এসেই হাউমাউ করে কান্না করে অভিযোগ করেছে। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি।
এদিকে, বাঘারপাড়ার মথুরাপুর মৌজায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে তিন শতক জমি দেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামে এক যুবক। কিন্তু সেই জমি তৎকালীন এমপি রণজিত কুমার রায় নিজের নামে লিখে নিয়েছেন। শর্ত ছিল তাকে চাকরি দেয়া হবে। কিন্তু ৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি লুটপাট হওয়ায় কাজ ভাল হয়নি। এজন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সেটি বুঝে নেয়নি। এখন চাকরিও নেই জমিও নেই আবদুল্লাহর। তিনি বলেন, সরল বিশ^াসে প্রকল্পের জন্য জমি দিয়েছিলাম। কিন্তু এমপি সাহেব নিজের নামে লিখে নিয়েছেন। আমি জমি ফেরত চাই।
বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক হাসান আলীকে (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দেয়ার কথা বলে ৫ বিঘা জমি তার অনুসারীর নামে লিখে নেন তৎকালীন এমপি রণজিত কুমার রায়। নির্বাচনে পরাজিত হন হাসান আলী। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন হাসান আলী। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের চাপে পড়ে সেই জমি হাসান আলীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন রণজিৎ রায়।
এ বিষয়ে হাসান আলী বলেন, দল ক্ষমতায় থাকতে রণজিত রায়ের অপকর্ম নিয়ে অনেক কথা বলেছি। দলের এই দুর্দিনে তাকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না।
এ বিষয়ে বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, রণজিত রায় এমপি থাকাকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঞ্চিত ও নির্যাতিত হয়েছে। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তার ইশারা ছাড়া বাঘারপাড়া-অভয়নগর উপজেলার প্রশাসন থেকে শুরু করে কিছুই নড়েনি। তার অপকর্মের দায়ভার এখন আ.লীগের ত্যাগী ও সাধারণ নেতাকর্মীদের উপর বর্তাচ্ছে।