রেহানা ফেরদৌসী
নিজ দেশের কয়েক বছর আগের আলোচিত একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি, রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবু মোহসিন খান (৫৮) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। ২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার রাত নয়টার পর তার নিজ বাসায় এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব হলো বৃদ্ধ বয়সে বিচ্ছিন্ন বা বিচ্ছিন্ন থাকার ব্যক্তিগত অনুভূতি, যার দরুন স্বাস্থ্যের অবনতির মতো জীবনের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকির সম্মুখীন বেশি হন । জনসংখ্যার পরিবর্তন, পারিবারিক কাঠামোর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাপি আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি , যাকে প্রায়শই ” দীর্ঘায়ু বিপ্লব ” বলা হয়, বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করেছে। ঐতিহ্যবাহী সহায়তা ব্যবস্থাগুলি এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে লড়াই করার কারণে অনেক বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হন। বাংলাদেশের জনমিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশক থেকেই বাংলাদেশে বয়স্ক বা প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকবে এবং ২৫ বছর পরেই বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি বয়স্ক সোসাইটিতে।
আধুনিক পারিবারিক গতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, পারমাণবিক এবং বৈচিত্র্যময় পারিবারিক কাঠামো বর্ধিত পারিবারিক নেটওয়ার্কের পরিবর্তে এসেছে। এই পরিবর্তনের ফলে প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক এবং যত্নশীল ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিকে সীমিত পারিবারিক সহায়তার সাথে “খালি বাসা” পর্যায়ে যেতে হচ্ছে। উপরন্তু, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং যুবসমাজের উপর সামাজিক জোর বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের সাংস্কৃতিক মর্যাদা হ্রাস করেছে, তাদের সামাজিক এবং সম্প্রদায়গত কার্যকলাপ থেকে আরও প্রান্তিক করে তুলেছে।
কোভিড এর মহামারী বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দুর্বলতাগুলিকে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত করেছে, তাদের বিচ্ছিন্নতা এবং পর্যাপ্ত যত্নের অভাবকে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছে। পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সত্ত্বেও, বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্করা প্রায়শই সামাজিক অগ্রাধিকারগুলিতে অদৃশ্য থেকে যায়, তরুণ প্রজন্মের উপর মনোযোগ দিয়ে তাদের চাহিদাগুলিকে ঢেকে দেওয়া হয়।
আসলে একটা মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার নিজের ভিতরে অজান্তেই কিছু জিনিস দানা বেধে ওঠে। যেমন- শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের উপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এগুলোর কারণে অনেকের মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষণ্নতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই ‘দ্বিতীয় শৈশব’ বলে মনে করেন। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। অথচ বার্ধক্য নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে যেমন কোন চিন্তা করতে দেখা যায় না, তেমনি প্রবীণদের জন্য সম্মানের সাথে আনন্দমুখর বার্ধক্য নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও নেই।
কিছু ওল্ড হোম বা প্রবীণ নিবাস থাকলেও সেগুলোতে যারা থাকেন তাদের নিয়ে নেতিবাচক প্রচারই বেশি হয় । যেমন বলা হয় ছেলে মেয়েরা বাসায় থাকতে দেয় না কিংবা খোঁজ খবর নেয় না বলেই তারা এখানে। অথচ পরিবার কাঠামো এবং বাস্তবতা বিবেচনা করলে বয়স্কদের জন্য অনেক সময় চাইলেও সন্তানরা পর্যাপ্ত সময় দিয়ে সেবা করতে পারে না। এ বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতে হবে। এদিকে কন্যা সন্তানের মাতা-পিতা খানিকটা অনিশ্চয়তা নিয়েই জীবনযাপন করেন। মা-বাবা আশা করেন বৃদ্ধ বয়সে তারা যেন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে পারেন। আর এজন্য প্রয়োজন কর্মক্ষম সন্তান। এই সন্তানটি ছেলে হলে কোনো মা-বাবা স্বস্তি বোধ করেন। কেননা, ছেলেসন্তানকে পালন করে সুশিক্ষিত করলে সে পরবর্তী সময়ে সংসারের হাল ধরবে। মা-বাবা বৃদ্ধ বয়সে নিরাপদে ও স্বস্তিতে কাটিয়ে দেবেন। কন্যাসন্তানকে বিয়ে দেয়ার পর সে নিজ সংসারে চলে যায়। সেখানে তার আয়-রুজির সুযোগ থাকলেও সেই আয়ের একটা অংশ তার মা-বাবা সাধারণত দাবি করেন না। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা এমন বিভিন্ন কারণে অবহেলিত হবেন, এটি পরিবার তথা রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক!
আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা দরিদ্র এবং নিঃসন্তান। আবার এমনও কিছু মানুষ আছেন যাঁদের সন্তানেরা তাঁদের দেখাশোনা করে না। এঁদের অধিকাংশ খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড হয় এই ধরনের অধিকাংশ বয়স্ক লোকের ঠিকানা। গ্রামাঞ্চলের এ ধরনের মানুষ সারা দিন ভিক্ষা করেন এবং রাত্রিযাপন করেন স্কুল বা সরকারি অফিসের বারান্দায়। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই শ্রেণির মানুষের অবস্থার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। অসহ্য গরম, প্রবল ঝড় বৃষ্টি কিংবা তীব্র শীত সবই তাঁদের সহ্য করতে হয়। এই বয়স্ক মানুষরা সর্বদা উপেক্ষিত এবং মানবেতর জীবন কাটান।
বৃদ্ধ বাবা-মাকে যারা বৃদ্ধাশ্রমে রেখেই ভাবছেন, তাদের দায়িত্ব শেষ। তাদের মনে কি একবারের মতো প্রশ্ন জাগেনি যে, অবহেলিত এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য মানসিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। মুখোশের ভিতর মুখ লুকিয়ে রেখে কি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে রাখা যায়!
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় যারা আমাদের জন্য ব্যয় করেছেন, তাদের প্রতি আমাদের দ্বায়বদ্ধতা থেকে যায়। মানুষ তার কর্মজীবনে সংসারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। তার মেধা ও শ্রম দেন। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তাদের পাশে দাঁড়ানোর। কেননা, বৃদ্ধ বয়সে কি হবে, সেই চিন্তা যদি যৌবনে করতে হয়, তাহলে মানুষের কর্মসক্ষমতা অনেক কমে যাবে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সরকারের নেয়ার বিষয়টি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
নেতিবাচকভাবে না দেখে বরং ইতিবাচক দৃষ্টি থেকেই প্রবীণ নিবাসের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কেয়ারের চিন্তা করা উচিত। সবশেষে একটি কথা নিজেকে এবং সম্মানিত পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, আমি-আপনি বৃদ্ধ বয়সে এই মনোকষ্টের ভার নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তো!
** তথ্য সংগ্রহ ঃ বিবিসি বাংলা।
লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)