বাংলার ভোর প্রতিবেদক
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী নভেম্বর থেকে এই অংশেও ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। আর প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে আশা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, পদ্মাসেতু রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে আশায় বুক বেঁধেছিল যশোরবাসী; সেই আশায় গুড়েবালি। রেলপথ বিভাগের সিদ্ধান্তের কারণে বৃহত্তর যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষের সেই স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। ট্রেনে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যশোর সদরের পদ্মবিলা রেলস্টেশনটি। যার অবস্থান যশোর শহরের মূল স্টেশন থেকে ১৫, বেনাপোল থেকে ৩৫, ঝিনাইদহ কোটচাদঁপুর স্টেশন থেকে ৪৫ কিলোমিটার এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্টেশন থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে। এই অঞ্চলের মানুষকে ট্রেনে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকায় যেতে হলে ১৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মবিলা স্টেশনে যেতে হবে। যা এই অঞ্চলের যাত্রীদের সময় ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে। এতে যাত্রীদের আগ্রহ কম। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী রেলযোগাযোগের সুবিধা বঞ্চিত হবেন। ভোগান্তি লাঘব, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে পদ্মাসেতুর রুটের সঙ্গে বেনাপোল-যশোর, দর্শনা-কোটচাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনের সংযুক্ত করার দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের রেলপথের কাজ। পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের বাকি থাকা এ কাজ শেষ হতে যাচ্ছে আগামী মাসেই। এরই মধ্যে টেস্ট অ্যান্ড কমিশনিং করে রেললাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। এই অংশের অগ্রগতি এখন ৯৭ দশমিক ছয় শূন্য শতাংশ। আর ভাঙা জংশনের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। আধুনিক এই জংশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যশোরের লাইন প্রকল্পটির ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৯৭ দশমিক সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ছয় চার শতাংশ। আর সার্বিক অগ্রগতি ৯৮ দশমিক এক ছয় শতাংশ।
আফজাল হোসেন বলেন, ভাঙ্গা থেকে যশোর নতুন রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চালু হবে নভেম্বরে। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার এই প্রকল্পের প্রায় ১৬২১ কোটি টাকা সাশ্রয়েরও আশা করা হচ্ছে। এদিকে নতুন পথে রেল লাইন চালুর খবরে খুশি মানুষ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদারকিতে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি সিঙ্গেল লাইনের ১৬৬ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মাণ করে।
এদিকে, পদ্মা সেতুর রেলওয়ে যোগাযোগের কাঙ্খিত সুবিধা পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বৃহত্তর যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষের। যশোর-ঝিনাইদহ কোঁটচাঁদপুর- চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে করে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যাওয়া আসায় সময় লাগে নয় থেকে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগের খবরে এই অঞ্চলের মানুষেরা উচ্ছ্বাসিত হলেও; এখন তাদের কাছে হতাশার আরেক নাম পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ। পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ সবচেয়ে বেশি উপকারভোগী হতো বৃহত্তর যশোরের যাত্রীরা। অথচ পদ্মাসেতু রেল প্রকল্পে বৃহত্তর যশোর জেলাকে বঞ্চিত করা হয়েছে দাবি করছেন বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।
সংগঠনটি জানিয়েছে, যমুনা সেতু দিয়ে বর্তমানে যশোরবাসী যশোর, কোটচাঁদপুর ঢাকার সাথে যোগাযোগের ৩টি ট্রেন পাচ্ছি। জুলাই মাসে পদ্মাসেতু রেল প্রকল্প চালু হলে এ রুটে মাত্র একটা ট্রেন পাবে। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষ চরমভাবে বঞ্চিত হবে। পদ্মাসেতু আমাদের স্বপ্নেই থেকে যাবে। তাই বেনাপোল-যশোর ঢাকা রুটে ২ টা ট্রেন, দর্শনা-যশোর-ঢাকা রুটে ২ টা এবং খুলনা থেকে যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা রুটের ট্রেনগুলো বহাল রাখতে হবে। পদ্মাসেতু দিয়ে ট্রেন সময়সূচী এমন করতে হবে যাতে যশোর থেকে ঢাকায় প্রতিদিন অফিস করতে পারে। আন্তঃনগর ট্রেনে সুলভ ( সাধারণ ) বগি ও কৃষি পণ্য – সবজি -ফুল-ফল-মাছ বহনের জন্য ‘ভ্যান্ডার’ ( মালবাহী বগী ) যুক্ত করতে হবে।
এ বিষয়ে যশোর আরএন রোডের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী নুরুজজ্জামান বলেন, ‘পদ্মাসেতু দিয়ে ট্রেন যাত্রা আমাদের যশোর অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে। সকালে যেয়ে কাজ শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতে পারব। কিন্ত বৃহত্তর যশোরের যাত্রীদের স্টেশন করেছে পদ্মবিলাতে। এতদূর থেকে পদ্মবিলা গিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা সবকিছুর জন্য বিড়ম্বনা।’
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, ‘বৃহত্তর যশোরবাসীর জন্য পদ্মাসেতু হয়ে যে ট্রেনগুলো চলাচল করবে, সেটির স্টেশন করেছেন পদ্মবিলাতে। এটি অপরিকল্পিত। ওখানে স্টেশন করাতে কোন যাত্রীই পাবে না। যাত্রী পেতে হলে বেনাপোলে স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ট্রেনগুলো। কেননা প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার যাত্রী ভারতে যাওয়া আসা করে। এর সিংহভাগ যাত্রীরা ঢাকা থেকে আসে বা যায়। ফলে বেনাপোল স্টেশনের সঙ্গে পদ্মাসেতু দিয়ে ট্রেন চালু হলে যাত্রী পাবে এবং দুই দেশের যাত্রীদের যে কষ্ট সেটা লাঘব হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা রেল বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। যাতে যশোর বেনাপোল যশোর স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।’
এ বিষয়ে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ‘পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগটা চালু হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বৃহত্তর যশোরের মানুষ। কিন্তু রেল বিভাগের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে সেই রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হবে বৃহত্তর যশোরের তিনটি জেলার মানুষ। খুলনা-যশোরের বন্দবিলা- ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার যে রুট করা হয়েছে; সেটা যশোরবাসীর কোন উপকার আসবে না। তিনটি জেলার যাত্রীরা পদ্মাসেতু দিয়ে ঢাকাতে যেতে হলে পদ্মবিলাতে যেতে হবে। সেটা এই অঞ্চলের যাত্রীদের জন্য সময় বিড়ম্বনার প্রধান সমস্যা। পদ্মাসেতুর কাঙ্খিত সুবিধা দিতে হলে এই অঞ্চলে যতগুলো স্টেশন আছে যেমন দর্শনা-কোটচাঁদপুর, বেনাপোল-যশোর স্টেশনে দুইটা করে মোট চারটা ট্রেন দিতে হবে। তা না হলে পদ্মাসেতুর রেলের সুবিধা পাবে না।’
খুলনা রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. মাসুদ রানা জানান, ‘নতুন রেললিংক চালু হবে। খুলনা থেকে সব ট্রেনই পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাবে। এ জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। নতুন করে টিকিটের বুথ বাড়ানো হচ্ছে। অন্যান্য প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি।’